অজয় রায়
রাশিয়া সামরিক অভিযান চালাচ্ছে ইউক্রেনে।
দেশটির বিভিন্ন অঞ্চলে বহু সামরিক পরিকাঠামো ধ্বংস করেছে। ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ শহরের কাছে পৌঁছে গিয়েছে রুশ বাহিনী। ডনবাস
অঞ্চলেও লড়াইয়ে উত্তরোত্তর পিছু হঠছে ইউক্রেনের সেনা। এদিকে
মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটো (নর্থ অ্যাটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশন) যুদ্ধে
প্ররোচনা দিয়ে চলেছে। মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেন অনেক আগে থেকেই অস্ত্রশস্ত্র ও সামরিক প্রশিক্ষণ জুগিয়ে
যাচ্ছিল ইউক্রেনের ফ্যাসিস্তদের। এখন ন্যাটোভুক্ত ২০টি দেশ বিপুল সমরাস্ত্র পাঠিয়েছে ইউক্রেনে। সীমান্তে আরও সেনা মোতায়েন
করা হয়েছে। পশ্চিমী দেশগুলি রাশিয়ার উপর নানান
নিষেধাজ্ঞাও আরোপ করেছে। এর মধ্যেই মস্কোর সঙ্গে কিয়েভের আলোচনা চলছে। এদিকে
সীমা্ন্ত পেরোতে যাওয়া অভিবাসীদের উপর ইউক্রেনের সেনার একাংশ বর্ণবিদ্বেষী হামলা
চালাচ্ছে বলেও শোনা যাচ্ছে। আর সংবাদমাধ্যম সূত্রে খবর, ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতি জেলেনস্কি
পোল্যান্ডে চলে গিয়েছেন।
গত ২১শে ফেব্রুয়ারি লুহানস্ক এবং দোনেৎস্ককে স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি
দেয় রাশিয়া। আর তার তিন দিন পরেই ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরু করে মস্কো। রাশিয়ার দাবি, ইউক্রেনকে নিরপেক্ষ থাকতে হবে অর্থাৎ ন্যাটোভুক্ত
করা চলবেনা। জনসাধারণের সুরক্ষার জন্য আর বিশেষত ডনবাস
অঞ্চলে শান্তি সুনিশিত করতেই এই সামরিক অভিযান বলে জানিয়েছে
মস্কো। তবে তারা ইউক্রেন দখল করবেন না। রুশ রাষ্ট্রপতি পুতিন যেমন ঘোষণা করেছেন, তাঁদের লক্ষ্য ইউক্রেনের বেসামরিকীকরণ
ও নাৎসিমুক্তকরণ। সম্প্রতি রুশ বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভাও বলেছেন, বিশ্বব্যাপী সংঘাত এড়ানোই
রাশিয়ার এই সামরিক অভিযানের লক্ষ্য।[১]
পুতিন এই অঞ্চলের সুরক্ষার জন্য বারংবার নতুন চুক্তি করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। গত
ডিসেম্বরেও নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার লক্ষ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর সদস্যদের কাছে একটি চুক্তির খসড়া পেশ করে রাশিয়ান ফেডারেশন। কিন্তু পশ্চিমী শক্তিগুলি বিষয়টি উপেক্ষা করে। আর কর্পোরেট মিডিয়া লাগাতার অপপ্রচার চালিয়ে
যায়। সেই দ্বিচারিতা এখনও চলছে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র,
ন্যাটো এবং ইউরোপের নিরাপত্তা ও সহযোগিতা সংস্থা (ওএসসিই) অতীতে
বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। ন্যাটো রাশিয়ার সীমানা পর্যন্ত সম্প্রসারিত হবেনা
বলেও নিশ্চয়তা দেওয়া হয়। যার প্রেক্ষিতে ১৯৯১ সালে মূল মিনস্ক চুক্তি স্বাক্ষরিত
হয়েছিল রাশিয়া, বেলারুশ এবং ইউক্রেনের মধ্যে। যাতে
সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলোপ ঘটানো হয়। কিন্ত পরবর্তীকালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও
ন্যাটো সেই চুক্তিভঙ্গ করে। যুগোস্লাভিয়াকে ধ্বংস করে।
পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলে হাজার হাজার সেনা ও বহু ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করে।
প্রাক্তন ওয়ারশ চুক্তিভুক্ত অনেক দেশকেই ন্যাটোয় যুক্ত করা হয়। এখন ইউক্রেনকে
ন্যাটোভুক্ত করার চেষ্টা চলছে। মস্কো অবশ্য দাবি জানিয়েছে, রাশিয়ার সুরক্ষা সুনিশ্চিত করতে হবে। ইউক্রেনকে সামরিক জোট নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশন (ন্যাটো)-এর সদস্য করা যাবেনা।
২০১৪ সালে চরম দক্ষিণপন্থীরা মার্কিন মদতে অভ্যুত্থান করেছিল ইউক্রেনে।
নির্বাচিত সরকারকে অপসারণ করে রুশবিদ্বেষী এক ফ্যাসিবাদী সরকার গড়ে তারা। যাতে সামিল
হয় নব্য-নাৎসিরা। ইউক্রেনের সেনা তখন থেকেই সেদেশের পূর্বাঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠ রুশ
জনজাতির মানুষের উপর হামলা ও জাতিবিদ্বেষী নিপীড়ন শুরু করে। গণহত্যা চালায়।
রুশভাষীদের ভাষা ও সাংস্কৃতিক অধিকার কেড়ে নেবার চেষ্টা করে। যখন রুশ ভাষাভাষী
ক্রিমিয়া প্রজাতন্ত্র গণভোটের মাধ্যমে রাশিয়ান ফেডারেশনে যুক্ত হয়ে যায়। লুহানস্ক এবং দোনেৎস্কের জনসাধারণও বীরত্বের সঙ্গে লড়াই চালাতে থাকেন; আর গণপ্রজাতন্ত্র
ঘোষণা করেন জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণের নীতি অনুসারে। তাঁদের প্রতিরোধ সংগ্রাম আরও
জোরদার হতে থাকে। রাশিয়াও তাঁদের সীমিত সহায়তা জোগায়।
ফলে ইউক্রেনের ফ্যাসিবাদীরা ও তাদের মদতদাতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটো ২০১৫
সালে সম্মত হয় দ্বিতীয় মিনস্ক চুক্তি করতে। যাতে লুহানস্ক ও দোনেৎস্কের
স্বায়ত্তশাসনের স্বীকৃতি দেওয়া হয়। আর যুদ্ধবিরতির ব্যবস্থা হয়। কিন্ত পরবর্তীকালে
এই চুক্তিভঙ্গ করে ক্রমাগত এঅঞ্চলের মানুষের উপর সামরিক আক্রমণ ও গোলাবর্ষণ চালিয়ে
যায় ইউক্রেনের সেনা ও নব্য-নাৎসি মিলিশিয়া। সেই হামলা
সাম্প্রতিককালে তীব্রতর হয়েছিল। গত আট বছরে ডনবাস
অঞ্চলে ১৪ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন।[২] এর মধ্যে একটা বড় অংশ বেসামরিক নাগরিক।[৩] বহু সামাজিক পরিকাঠামোও ধ্বংস করা হয়েছে।
স্পষ্টতই মার্কিন-রাশিয়া আন্তসাম্রাজ্যবাদী দ্বন্দ্ব তীব্রতর হচ্ছে। ইউক্রেনের পুতুল সরকারের মাধ্যমে রাশিয়াকে যুদ্ধে প্ররোচনা দিয়ে চলেছে
পশ্চিমী সাম্রাজ্যবাদী শক্তি। ভূরাজনৈতিক দিক থেকে
গুরুত্বপূর্ণ এই অঞ্চল। ওয়াশিংটনের লক্ষ্য রাশিয়াকে ঘিরে ফেলা। আর ক্রমে সমগ্র
ইউরোপে আধিপত্য বিস্তার করা। আন্তর্জাতিক মহলের একাংশের
অবশ্য বক্তব্য, সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলির কূটনৈতিক আলোচনার
মাধ্যমে এই সঙ্কটের শান্তিপূর্ণ সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।
০৫/০৩/২০২২
তথ্যসূত্র
[১]
“Russian Operation Seeks to Avoid Global Conflict: Zakharova”, February 24,
2022, TeleSUR
[২] “About 14,000 people killed during conflict in Donbass, top
Ukrainian diplomat says”, May 13, 2021, TASS
[৩] ‘‘More than 2,600 civilians killed, 5,500 others wounded
in Donbass over past 8 years – IC’’, February 23, 2022, TASS
---