Sunday, January 9, 2022

দেওচা-পাচামিতে প্রস্তাবিত কয়লাখনির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ আন্দোলন চলছে

 

অজয় রায় 

     কয়লাখনি প্রকল্পের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে মানুষ সোচ্চার হচ্ছেন দেওচা-পাচামি-দেওয়ানগঞ্জ-হরিণসিঙ্গাতে আন্দোলনে নেমেছেন আদিবাসীরা কিন্তু পুলিশ দিয়ে আন্দোলন দমন করার চেষ্টা করছে স্বৈরাচারী রাজ্যসরকার প্রশাসনের তরফে হুমকি দেয়া হচ্ছে। আর মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হচ্ছে। সম্প্রতি দেওয়ানগঞ্জে আন্দোলনরত মহিলাদের উপর নির্যাতনও চালিয়েছে পুলিশ। 

     বীরভূম জেলায় দেওচা-পাচামি-দেওয়ানগঞ্জ-হরিণসিঙ্গা কয়লা ব্লক অবস্থিত। যেখানে ২১০ কোটি টন কয়লা মজুত রয়েছে বলে অনুমান করা হচ্ছে।[] দেওচা-পাচামিকে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম কয়লাখনি আখ্যা দেওয়া হচ্ছে .লক্ষ একর জায়গা জুড়ে এই প্রকল্পটি তৈরি করতে চায় সরকার যেখানে গ্রামগুলিতে মোট প্রায় ২১ হাজার মানুষ বসবাস করেন, যার মধ্যে নহাজারের বেশি আদিবাসী। 

     রাজ্য সরকারের সংস্থা ওয়েস্ট বেঙ্গল পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন লিমিটেডকে কয়লা ব্লকটি বরাদ্দ করা হয়েছে এই প্রকল্পে প্রায় লক্ষ কর্মসংস্থান হবে বলেও দাবি করা হচ্ছে।[] আর পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তরফে বলা হয়েছে, এই কয়লাখনি প্রকল্পে রাজ্য সরকারের মোট বিনিয়োগের পরিমাণ হবে ৩৫ হাজার কোটি টাকা।[] গত ৯ই নভেম্বর পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী দেওচা-পাচামিতে ১০ হাজার কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন তবে এলাকার মানুষ উচ্ছেদ হওয়ার আশঙ্কা করছেন তাঁদের অভিযোগ, এই প্রকল্পে যারা প্রকৃতপক্ষে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন, তাঁদের সঙ্গে কোন আলোচনা না করেই অগণতান্ত্রিকভাবে এই প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে। সংবাদমাধ্যম সূত্রেও খবর, অধিকাংশ এলাকাবাসীই এই কয়লাখনির পক্ষে নন

     এঅঞ্চলে অনেকগুলি পাথর খাদান ও পাথর ভাঙার কল চলছে, যার অধিকাংশই অননুমোদিত। বেআইনি খনিও আছে ফলে ইতিমধ্যেই যথেষ্ট দূষণ ছড়িয়েছে কয়লা খনি হলে আরও ব্যাপকভাবে দূষিত হবে জল, বায়ু এবং ভূমি কয়লাখনি প্রকল্প হলে মানুষ ঘরছাড়া হবেন কৃষকরা তাঁদের জমি হারাবেন ফলে কৃষক, কৃষি শ্রমিক পাথর খাদান মজুরেরা জীবিকাচ্যুত হবেন আদিবাসীরা তাঁদের চিরায়ত চারণভূমি থেকে উৎখাত হবেন। বনাঞ্চল ধ্বংস হলে আদিবাসীরা বনজসম্পদ সংগ্রহ করে জীবনধারণ করার সুযোগও হারাবেন

     কয়লাখনি তৈরি হলে দেওচা-পাচামি সহ পার্শ্ববর্তী বিস্তীর্ণ অঞ্চলের পরিবেশ স্থায়ীভাবে ধ্বংস হয়ে যাবে এঅঞ্চলে বর্তমানে জলের সংকট আছে ভবিষ্যতে জলস্তর আরও নেমে যাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে জনপদ। কৃষিজমি নষ্ট হবে। অরণ্য, জীববৈচিত্র আর নদী ও জলাশয়গুলির বিনাশ ও বিলুপ্তি ঘটবে অঞ্চলিক সংস্কৃতিও ধ্বংস হবে

     ভূতত্ত্ববিদদের মতে, এখানে কয়লা রয়েছে মাটির অনেকটা নিচে তার উপরে আছে কঠিন পাথরের পুরু স্তর ফলে এর থেকে কয়লা উত্তোলন করা শক্ত খরচ সাপেক্ষ দেশীয় প্রযুক্তির মাধ্যমে তা করা সম্ভব নয় পশ্চিমবঙ্গ ছাড়াও কর্ণাটক, বিহার, পাঞ্জাব, তামিলনাড়ু, উত্তরপ্রদেশ এবং শতদ্রু জলবিদ্যুৎ নিগমকে এই খনিটি থেকে কয়লা উত্তোলনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল কিন্তু তারা আর আগ্রহ দেখায়নি রাজ্য সরকারকে এই খনিটির থেকে কয়লা উত্তোলন বিদেশী সংস্থার সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে করতে হবে প্রযুক্তির জন্য ফলে দেশের সম্পদ কর্পোরেট সংস্থার অবাধ লুন্ঠনের জন্য আরও উন্মুক্ত হবে। এক্ষেত্রে দুর্নীতির আশঙ্কাও আছে

     আর লক্ষণীয় যেটা, তা হল এখানে মাটির তলার খনি হচ্ছেনা খোলামুখ খনি করার চেষ্টা চলছে যার থেকে মুনাফার জন্য যান্ত্রিক পদ্ধতিতে কয়লা তোলার ব্যবস্থা করা হবে বলেই ওয়াকিবহাল মহলের ধারণা ফলে এই উদ্যোগ শ্রমনিবিড় হবে না বরং, এখানে কর্মসংস্থানের সুযোগ হতে পারে কেবলমাত্র সীমিত সংখ্যক দক্ষ শ্রমিকের

     দেওচা-পাচামিতে কয়লাখনির বিষয়ে এখন পর্যন্ত উপযুক্ত সমীক্ষা করা হয়নি ফলে এই খনির পরিকল্পনা কতটা বিজ্ঞানসম্মত ও বাস্তব তথ্যভিত্তিক, তা নিয়ে বিভিন্ন মহল সন্দেহ প্রকাশ করেছে। এক্ষেত্রে স্পষ্টতই অস্বচ্ছতা রয়েছে কয়লাখনি করার নামে আদিবাসীদের উচ্ছেদ করে জমি দখলের চক্রান্ত চলছে আর কর্পোরেটদের জল-জঙ্গল-জমি লুঠের পথ প্রশস্ত করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ উঠেছে

     প্রস্তাবিত কয়লাখনির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-আন্দোলনের উপরে দমন-পীড়ন নামিয়ে আনছে প্রশাসন। বিভ্রান্তিমূলক প্রচার চালানো হচ্ছে। এলাকার মানুষদের একাংশকে নানা প্রলোভন দেখিয়ে আন্দোলনের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টির ষড়যন্ত্রও চলছে বীরভূমের আদিবাসীদের সংগঠন আদিবাসী গাঁওতাতে যেমন ভাঙন ধরানো হয়েছে।

     এদিকে যেটা লক্ষণীয়, বিভিন্ন কয়লাখনি-সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের সাধারণ মানুষের কিন্তু তেমন কিছু আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ঘটেনি বরং তাঁদের অবস্থা শোচনীয় দূষণের কারণে রোগ ও মৃত্যু বেড়েছে কয়লার ধুলোয় কৃষিভূমি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে আবার কোথাও কোথাও উচ্ছেদ হওয়া মানুষরা কোনও ক্ষতিপূরণ এবং পুনর্বাসনও পাননি স্পষ্টতই সেখানকার মানুষের খাদ্য, কাজ ও জীবনের অধিকারের উপর আক্রমণ নেমে আসছে। আর সেই সঙ্গে বিভিন্ন এলাকায় দেখা যাচ্ছে কয়লা মাফিয়াদের অবৈধভাবে কয়লা তোলার দৌরাত্ম্য ও দুর্নীতি। ধস, গ্যাস, আগুন এবং বেআইনি খনিতে মৃত্যুর সমস্যা তো রয়েছেই

     বিশ্ব উষ্ণায়ন জলবায়ু পরিবর্তনের দরুন বর্তমানে জীবাশ্ম জ্বালানির পরিবর্তে পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তির ব্যবহারে জোর দিচ্ছেন বিশ্বের বিজ্ঞানীমহল কিন্তু মোদী সরকার কয়লা ক্ষেত্রে ১০০ শতাংশ প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগে অনুমতি দিয়েছে কেন্দ্রের এই নয়া উদারবাদী সংস্কারের পদক্ষেপের ফলে কয়লাশিল্পে বেসরকারীকরণের পথ আরও প্রশস্ত হয়েছে। এরাজ্যের সরকারও দেওচা-পাচামিতে বেসরকারী সংস্থার সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে কয়লাখনি তৈরি করার দিকে এগোচ্ছে। এই কয়লাখনি গড়ে শিল্পায়ন কর্মসংস্থান করার ভিত্তিহীন প্রতিশ্রুতি দিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা তোলাই সরকারের মূল উদ্দেশ্য বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশ

     দেওচা-পাচামিতে জনসাধারণের প্রকৃত উন্নয়নের জন্য জনমুখী বিকল্প পথ অনুসরণ করা প্রয়োজন সেচের ব্যবস্থা, কৃষির উন্নয়ন ও সেই সঙ্গে পশুপালন বৃদ্ধি আর বনসৃজন করা দরকার অননুমোদিত পাথর খাদান পাথর ভাঙার কল বন্ধ করা এবং পরিবেশ সংরক্ষণ জরুরি আর সৌরবিদ্যুতের মতো পরিচ্ছন্ন নবীকরণযোগ্য শক্তির ব্যবহারে জোর দেওয়া এবং পরিবেশবান্ধব শিল্পায়ন করা উচিত যা কর্মসংস্থান টেকসই উন্নয়নের পথ হতে পারে বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞদের একাংশ

০৩/০১/২০২২

তথ্যসূত্র

[] "Mamata announces Rs 10,000-crore compensation package", November 10, 2021, The Indian Express

https://indianexpress-com.cdn.ampproject.org/v/s/indianexpress.com/article/cities/kolkata/mamata-announces-rs-10000-crore-compensation-package-7615768/lite/?amp_js_v=a6&amp_gsa=1&usqp=mq331AQKKAFQArABIIACAw%3D%3D#aoh=16408665673909&csi=1&referrer=https%3A%2F%2Fwww.google.com&amp_tf=From%20%251%24s&ampshare=https%3A%2F%2Findianexpress.com%2Farticle%2Fcities%2Fkolkata%2Fmamata-announces-rs-10000-crore-compensation-package-7615768%2F

[] Ibid

[] Ibid

--- 

No comments:

Post a Comment

Progressive Social Movements and Activists

Ajay Roy A few days ago, one of my friends was talking about various personal problems in life. How they have blocked his scope of social ac...