অজয় রায়
গত ৩১শে অগাস্ট আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার সম্পূর্ণ হয়েছে। তালিবান সরকার গড়ার উদ্যোগ নিচ্ছে। স্পষ্টতই, সেদেশে জনজীবন বিধ্বস্ত হয়েছে সাম্রাজ্যবাদীদের চক্রান্ত্রে; বৃহৎ শক্তিগুলির ভূরাজনৈতিক ক্ষমতার খেলায়। যার পরিণতিতে তালিবানরা ফের ক্ষমতায় ফিরেছে।
মার্কিন সেনা যেভাবে প্রত্যাহার করা হয়েছে, তাতেই পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উল্লেখযোগ্য শক্তি ক্ষয়। সেই সঙ্গে লক্ষণীয়, ক্রমবর্ধমান বহুমেরুত্বের প্রবণতা। ইউরেশিয়ায় মার্কিন প্রভাব বহুলাংশেই কমে গিয়েছে। শূন্যস্থান পূরণে প্রতিযোগিতায় নেমেছে বিভিন্ন দেশ। বৃহৎ শক্তি চীন ও রাশিয়া; আঞ্চলিক শক্তি পাকিস্তান, ইরান এবং ভারত। এদের মধ্যে ভারত ছাড়া বাকিদের অনেকেরই অবস্থান মূলত মার্কিনবিরোধী।
আফগানিস্তান দক্ষিণ এশিয়া ও মধ্য এশিয়ার প্রবেশদ্বারে রয়েছে। আর ইউরেশিয়া তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস এবং খনিজে সমৃদ্ধ। ফলে এঅঞ্চলে নিয়ন্ত্রণ রাখতে চায় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি। ওয়াশিংটন ও ন্যাটো যেমন গত দুই দশক ধরে দখলদারির চেষ্টা চালায়। ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের’ অছিলায়। কিন্তু তারা বিভিন্ন সময়ে কার্যত সন্ত্রাসবাদকেই ব্যবহার করে চলেছে ভূরাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষা করতে। নারীর অধিকার রক্ষার দোহাই দিয়েও হস্তক্ষেপ করেছে। অথচ নিজেরা মৌলবাদী যুদ্ধবাজদের এক পক্ষের বদলে অপর পক্ষকে মদত দিয়েছে। যাতে হিংসার পথ আরও প্রশস্ত হয়েছে।
এদিকে লক্ষণীয় যেটা, তালিবান গেরিলাদের সঙ্গে যুদ্ধে পরাস্ত হয়েছে পরাশক্তির অত্যাধুনিক সেনাবাহিনী। তবে এতে উৎসাহিত হয়েছে সন্ত্রাসবাদী ও ইসলামিক মৌলবাদীরাও। আফগানিস্তানের সঙ্গে ছয়টি দেশের সীমান্ত রয়েছে। এখন এঅঞ্চলের বিভিন্ন দেশ উদ্বিগ্ন। তারা জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে তালিবানদের সঙ্গে সমঝোতায় আসতে চাইছে, যাতে আফগানিস্তান থেকে সন্ত্রাসবাদ রপ্তানি না হয়। তালিবানরাও এব্যাপারে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। তবে তালিবানরা বহু সন্ত্রাসবাদীকে আফগান কারাগারগুলির থেকে মুক্তি দিয়েছে বলে সংবাদমাধ্যম সূত্রে খবর। সম্প্রতি কাবুল বিমান বন্দরে ইসলামিক স্টেট খোরাসন প্রভিন্স সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হামলাও চালিয়েছে।
এর মধ্যে চীনের অবশ্য বেশ কিছুটা সুবিধা হয়েছে। তাদের নতুন রেশম পথ নির্মাণের উদ্যোগে এঅঞ্চলের অন্যান্য দেশগুলিকে যুক্ত করছে। এই বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগের ফলে ইউরেশিয়ার ভূরাজনৈতিক ও ভূঅর্থনৈতিক ভিত্তির পরিবর্তন হতে পারে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞদের একাংশ। আর বেজিং চায়, জিয়াংজিং প্রদেশের উইঘুর ইসলামিক জঙ্গিদের সংগঠনকে যেন তালিবানরা মদত না দেয়।
আন্তর্জাতিক মহলের একাংশ চাপ দিচ্ছে তালিবানদের প্রতিনিধিত্তমূলক সরকার গড়ার জন্য। যাতে এঅঞ্চলে স্থিতিশীলতা বজায় থাকে। মানবিক সহায়তা, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ইত্যাদি বিষয়কে তারা কৌশল হিসাবে ব্যবহার করার চেষ্টা করছেন। নারীর অধিকার সহ মানবাধিকার রক্ষায় জোর দিচ্ছেন। দেশটির শান্তিপূর্ণ পূনর্নিমাণের বিষয়টিও আলোচনায় উঠে আসছে। যখন স্পষ্টতই সেদেশে কর্পোরেট স্বার্থ রক্ষা এবং বিনিয়োগ সুরক্ষিত রাখার উদ্দেশ্যও রয়েছে। তালিবানদের সঙ্গে কূটনৈতিক আলোচনা চলছে। এব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকায় চীন-রাশিয়া।
তালিবানদের কার্যত স্বীকৃতি দেওয়ারই ইঙ্গিত দিয়েছে আন্তর্জাতিক মহলের একাংশ। প্রথম অবশ্য স্বীকৃতি দেয়ার পথে হাঁটে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র — গত বছরের ২৯শে ফেব্রুয়ারি কাতারের দোহায় তালিবানদের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমে। সেই চুক্তি অনুযায়ীই সব কিছু হয়েছে। মার্কিন সেনা সরে গেছে। পশ্চিমী-মদতপুষ্ট রাষ্ট্রপতি আশরাফ গনির সরকারের পতন হয়েছে। আর তালিবানরা ক্ষমতায় ফিরেছে। পঞ্জশিরে নর্দার্ন অ্যালায়েন্স সক্রিয় আছে বলে দাবি করছে। তবে তালিবানরা সম্প্রতি ‘পঞ্জশির দখলের’ পাল্টা দাবি করেছে। আর আফগানিস্তানের বাকি সবটাই এখন তালিবানদের দখলে।
তালিবানরা বিভিন্ন গোষ্ঠীর জোট। তবে তারা আদতে ধর্মোন্মাদ প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি। আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেতে ‘মডারেট’ সাজার চেষ্টা করছে। বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। কিন্তু গত দুই দশকের অভিজ্ঞতার থেকেও তারা কিছু শিক্ষা নিয়ে থাকতে পারে বলে বিশ্লেষকদের একাংশের ধারণা। চাপের মুখে তালিবানরা কি করে, এখন সেটাই দেখার।
০৫/০৯/২০২১
---
No comments:
Post a Comment