Ajay Roy
গত ১১ই সেপ্টেম্বর পেরুর কাল্লাও নৌঘাঁটিতে বন্দি অবস্থায় আবিমায়েল গুজমান (কমরেড গঞ্জালো) মৃত্যুবরণ করেন। তিনি গত ২৯ বছর কারারুদ্ধ ছিলেন। রাজনৈতিক বন্দিদের মানবাধিকার সংক্রান্ত বিধি ও রীতি এক্ষেত্রে লঙ্ঘন করা হয়েছে এবং তাঁকে উপযুক্ত চিকিৎসার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে হত্যা করা হয়েছে বলেও মানবাধিকার সংগঠনসহ বিভিন্ন মহল থেকে অভিযোগ উঠেছে।
গুজমান পেরুভিয়ান কমিউনিস্ট পার্টি (শাইনিং পাথ)-এর প্রতিষ্ঠাতা। তিনি কমরেড গঞ্জালো নামেও পরিচিত ছিলেন। ১৯৩৪ সালে মোলেন্ডো শহরে তাঁর জন্ম হয়। যৌবনেই তিনি কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রতি আকৃষ্ট হন। পেরুর আয়াকুছোয় হুয়ামাঙ্গা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ড: গুজমান দর্শনে অধ্যাপনা করেন। পরবর্তীকালে তিনি চীনের সর্বহারা সাংস্কৃতিক বিপ্লবের দ্বারা অনুপ্রাণিত হন। পেরুর কমিউনিস্ট আন্দোলনকে পুনর্সংগঠিত করেন তিনি। আর ১৯৬৯ সালে প্রতিষ্ঠা করেন পেরুভিয়ান কমিউনিস্ট পার্টি (শাইনিং পাথ)। তিনি ছিলেন ঐ দলের চেয়ারম্যান। তখন পেরুতে মার্কিন মদতপুষ্ট সামরিক শাসন চলছিল।
১৯৮০ সালে পেরুতে সশস্ত্র শ্রেণী সংগ্রামের সূচনা করে শাইনিং পাথ।[১] সাম্রাজ্যবাদ ও সেদেশের শাসক শ্রেণীকে নিশানা করে। নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করার লক্ষ্য ঘোষণা করে। তাঁদের আন্দোলন ব্যাপক আকার ধারণ করে।
কিন্তু ১৯৯২ সালের ১২ই সেপ্টেম্বর লিমাতে গুজমান গ্রেফতার হন। তাঁকে পরবর্তী ২৯ বছর কারারুদ্ধ রাখা হয়। তাঁর বারংবার বিচার হয়। তবে সেই বিচারের বৈধতা নিয়েই বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন ওঠে। সাম্প্রতিককালেও দেশ বিদেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলি সহ নানা পক্ষের থেকে তাঁর মুক্তির যে দাবি করা হয়, পেরুর বর্তমান ‘বামপন্থী’ সরকার তা উপেক্ষা করে।
শীর্ষনেতাদের গ্রেপ্তার হওয়ার পর শাইনিং পাথ দল ক্রমে দুর্বল হয়ে যায়। তবে তাঁরা এখনও পেরুর মূলত গ্রামীণ অপুরিমাক, এনে এবং মানতারো নদী উপত্যকা (ভিআরএইএম) অঞ্চলে সক্রিয় রয়েছে।[২]
১৯৮০ সাল থেকে পরবর্তী দুই দশকের মধ্যে পেরুতে অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষে প্রায় ৬৯,০০০ মানুষ নিহত বা নিখোঁজ হন। পেরুভিয়ান ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশনের (পিটিআরসি) মতে, যতজন শাইনিং পাথের দ্বারা নিহত হন, সামরিক স্বৈরশাসক ফুজিমোরি’র সেনা-কমান্ডোদের হাতে কমপক্ষে ততজন মানুষ মারা যান।[৩]
পেরুর বিপ্লবী সংগ্রামে আবিমায়েল গুজমান’র (কমরেড গঞ্জালো) অবদানকে সেদেশের কমিউনিস্টদের একাংশ গঞ্জালো চিন্তা রূপে অভিহিত করেন। কমিউনিস্টদের আন্তর্জাতিক সংগঠন রেভলিউশনারি ইন্টারন্যাশনাল মুভমেন্ট গঠনেও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন তিনি। সর্বহারার বিজ্ঞানে মাও সে-তুঙ-এর অবদানকে মার্কসবাদের তৃতীয় ও উচ্চতর পর্যায় রূপে মাওইজম পরিভাষায় প্রথম অভিহিত করার উদ্যোগ নেন যারা, তাঁদের অন্যতম ছিলেন তিনি। এমএলএম মতাদর্শের প্রসারেও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেন।
তবে বামপন্থী পর্যবেক্ষকদের একাংশের মতে, কোন কোন মহল থেকে গঞ্জালো চিন্তাকে সার্বজনীন বলে যে দাবি করা হয় তা যুক্তিযুক্ত নয়। শাইনিং পাথের একাংশের মধ্যে কিছু গোঁড়ামি এবং ব্যক্তিপূজার ঝোঁকও দেখা দিয়েছিল। তাছাড়া যুক্তফ্রন্টের কৌশলকে উপযুক্তভাবে ব্যবহার করার ক্ষেত্রে গুজমান’র (কমরেড গঞ্জালো) দুর্বলতা ছিল। ১৯৯০ সালের মধ্যেই জনফৌজের শক্তিকে এবং শহুরে অভ্যুত্থানের সম্ভাবনাকে অতিরিক্ত বড় করে দেখেছিলেন তিনি। শাইনিং পাথের সংগ্রামের অভিজ্ঞতার ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয় দিক থেকেই বামপন্থীদের শিক্ষা গ্রহণ করার বিষয়ে বামপন্থী বিশ্লষকদের একাংশ গুরুত্ব আরোপ করেছেন।
পেরু সহ বিশ্বের নানা প্রান্তে বিভিন্ন বামপন্থী দল ও সংগঠন কমিউনিস্ট নেতা আবিমায়েল গুজমান'র (কমরেড গঞ্জালো) হত্যার প্রতিবাদ করেছেন এবং তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেছেন।
১৫/০৯/২০২১
তথ্যসূত্র:
[১] ‘‘Abimael Guzman, head of Peruvian rebel group Shining Path, dies’’, September 11, 2021, ALJAZEERA
[২] “Shining Path leader dies of pneumonia in Peruvian prison”, September 12, 2021, La Prensa Latina Media
[৩] Peter Koenig, ‘‘Peru at the brink of civil war? The uprising of the dispossessed’’, June 22, 2021, MR Online
https://mronline.org/2021/06/22/peru-at-the-brink-of-civil-war-the-uprising-of-the-dispossessed/
No comments:
Post a Comment